কান্দা কাটায় বিপন্ন জীববৈচিত্র্য, শঙ্কিত কৃষক

হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধের নামে সবাই কান্দা কাটার মহোৎসবে গাঁ ভাসিয়েছে। হাওর বিধ্বংসী বেকু মেশিনের তাণ্ডবে একের পর এক কান্দা রূপ নিচ্ছে ডোবা—নালায়। অপরিকল্পিত খামখেয়ালি কর্মকাণ্ডে ঝোপঝাড়—জঙ্গল ও প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর কান্দা এখন মৃত্যুপুরীর পথে এগিয়ে চলেছে। হাওরের অলংকারখ্যাত কান্দা এভাবে কাটা হলে শুধু জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে তা নয়, হাওরপারের কৃষকেরাও গভীর সমস্যায় ভোগবে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে সহসাই পরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণে মনোযোগ দেওয়ার তাগিদ সচেতন মহলের।

হাওর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পিআইসির (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) লোকজন হাওর রক্ষা বাঁধে মাটি ফেলতে মহাধুমধামে কাটছে হাওরের বস্তি কান্দা। ইঞ্জিনচালিত বেকু মেশিন দ্বারা প্রকৃতির উপর জোর—জবরদস্তি চালিয়ে কান্দার পর কান্দায় খানাখন্দের সৃষ্টি করা হচ্ছে। নতুন—পুরাতন গর্তে খাঁখাঁ করছে হাওরের বুক। কিছুদিন আগেও যেখানে ছিল গোচর, সে জায়গা এখন ডোবা—নালায় রূপান্তরিত হয়েছে। যান্ত্রিক তৎপরতায় হাঁফিয়ে উঠা হাওর দেখে মনে হয়েছে, মানুষের নির্দয় অপতৎপরতা সইতে পারছে না হাওরের প্রকৃতি। কান্দা কর্তনের এমন অশুভ কর্মকাণ্ড চলতে থাকলে নিকট ভবিষ্যতে কৃষকের কাজে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ নিশ্চিতভাবে জীববৈচিত্র্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে।

হাওরপারের কৃষকরা জানান, কান্দা হচ্ছে হাওরের প্রাণ। হিজল—করচসহ নানা জাতের উদ্ভিদ জন্মে এই কান্দায়। এখানে অযত্নে বেড়ে ওঠা গাছ—গাছালি ও ঝোপঝাড়ে আশ্রয় নেয় নানা প্রজাতির পাখি এবং বন্যপ্রাণী। কৃষকের ফসল মাড়াই থেকে শুরু করে ধান ও খড় শুকানোর কাজে ব্যবহৃত হয় কান্দা। গোচারণ ভূমি হিসেবেও কান্দার বিকল্প নেই। হাওরের কান্দা একসাথে এতকিছুর সংস্থান করলেও তা রক্ষার বদলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে দাঁড় করানো হচ্ছে।

আরো পড়ুন  আখাউড়ায় বন্যা, বিপজ্জনক অবস্থায় হাওড়া নদীর পানি

শাল্লার উজানগাঁওয়ের কৃষক চন্দন দে বললেন, ছায়ার হাওরে এক সময় অসংখ্য কান্দা ছিল। গ্রামের পাশের ছোট বিলের পাড়ে ২০—২৫ বছর আগেও কচ্ছপে ডিম পাড়তো, পাখি আসতো, শিয়াল ডাকতো। এখন কান্দা কমে গেছে গোটা হাওরেই। প্রভাবশালীরা কেটে কেটে ফসলের ক্ষেত করছে। এখন আর কচ্ছপের দেখা মিলে না, পাখিও আসা কমে গেছে, শেয়ালও কালে ভদ্রে দেখা যায়। গেল সাত আট বছর হয় বাঁধের কাজে মাটি নিতে নিতে কান্দা কেটে বিনাশ করা হচ্ছে।

দিরাই উপজেলার বেকায়ালিয়া কান্দার পাড়ের আমিরপুরে বাড়ি কৃষক শামছুল ইসলামের।

বললেন, বোয়ালিয়া কান্দা, মইষখারার কান্দা, দিবদড়ির কান্দা ও বেরাজালির কান্দায় একসময় দিনের বেলা যেতে হলে কয়েকজন মিলে একসঙ্গে গেছে। বন বাদালি, ছন খাগড়ায় ভরপুর ছিল কান্দা। গরু’র ঘাষের জন্য কোন চিন্তাই করতো না কেউ। ধান মাড়াই দিতেও অসুবিধা ছিল না। গেল ৫০ বছরে সব কান্দা শেষ। বনবাদালিতো নেই—ই, কান্দার মাটিও নেই। এখন বাঁধের কাজে বছরে বছরে কান্দা কাটা হচ্ছে।

প্রতি বছর অপরিকল্পিত ও দায়সারাভাবে নির্মিত বাঁধের মাটি নদীতে গিয়ে পড়ছে। তাতে নদী ভরাট হয়ে পানি ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে অল্প বৃষ্টিতে নদীর পানি ফুলেফেঁপে হাওর উচ্চ ঝুঁকিতে পড়ছে। এ অবস্থায় হাওরে পরিকল্পিত টেকসই বাঁধ নির্মাণে নজর দেওয়ার দাবি কৃষকসহ হাওর সচেতন মানুষের।

হালি হাওরপারের দুর্গাপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব কৃষক মিহির লাল রায় বলেন, কৃষক হাওরে ধান লাগিয়ে কান্দায় হিজল—করচের ছায়ায় বসে। সেখানে গরু—বাছুরের ঘাস খাওয়ানো থেকে শুরু করে সব কাজই করা হয়। কান্দার ঝোপ—ঝাড়ে ওহাব, শিয়াল, বিভিন্ন জাতের পাখি নিরাপদে চলাফেরা করে। কিন্তু এইভাবে কান্দা কাটা হলে সবদিক থেকেই ক্ষতি হবে। কান্দা না কেটে বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণ করা দরকার।

আরো পড়ুন  ‘শিক্ষার্থীরা যেন পিছিয়ে না থাকে তা আমরা নিশ্চিত করতে চাই’

হাওর সচেতন মানুষ হিসেবে পরিচিতি ইউপি সচিব অজিত রায় বলেন, ২০১৭ সালের প্রলঙ্করী হাওর বিপর্যয়ের পর বর্তমান অবধি হাওর নিয়ে একপেশে চিন্তা—ভাবনা শুরু হয়েছে। আমরা ফসল রক্ষায় অধিকতর গুরুত্ব দিতে গিয়ে হাওরের জীববৈচিত্র্যের অপমৃত্যু ঘটাচ্ছি। যদিও হাওরের ফসল রক্ষা অবশ্যই জরুরী। তার সাথে জরুরী হাওর ও হাওরপারের সৌন্দর্য বৃদ্ধির বিষয়টিও।

শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য কান্দা বাঁচিয়ে রাখা একান্ত প্রয়োজন। গবাদি পশুর খাদ্য অর্থাৎ প্রাকৃতিক ঘাস কান্দাতে জন্মে। কান্দা কাটার মাটি বাঁধে ফেলায় তা নদী—হাওর দুইদিকে পড়ে ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনছে। অদূর ভবিষ্যতে কান্দা বিলুপ্তির কারণে হাওরবাসীকে আরেক যুদ্ধে নামতে হবে। এ জন্য উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী বোর্ড গঠন করে হাওরে সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, জেলায় আড়াই থেকে তিন হাজার হেক্টর কান্দা ভূমি আছে। এগুলোতে বন বাদালি কমেছে। তবে কোন কোন কান্দায় হিজল—করচের বাগ আছে এখনো। কৃষকের বীজতলার কাজে ব্যবহৃত হয় এখন কান্দা। হাওরের কান্দা ও গোচারণ ভূমি রক্ষার বিষয়টি এখন চিন্তার বিষয়। প্রতিবছর এভাবে কান্দা কেটে বাঁধ দেওয়া হলে আগামী এক দশক পর হাওরে মাটি সংকট দেখা দেবে। আমরাও বলছি, এখন আর কান্দা কেটে মাটি নয়, স্লুইস গেট বা রাবার ড্যাম করতে হবে। এজন্য বিভিন্ন সভায় প্রস্তাব করছি আমরা।

সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, যেখানে গাছপালা নেই সেখান থেকে মাটি নেওয়া হচ্ছে। এটা কৃষকের সম্মতিক্রমেই করা হচ্ছে। হঁ্যা, হাওরে এখন মাটির সঙ্কট চলছে। আগামী দিনে সঙ্কট আরও ঘনিভূত হবে। কান্দা না কেটে বিকল্প হিসেবে কি করা যায়। কারণ ফসল বাঁচাতে হলে বাঁধ দিতে হবে। এটা নিয়ে পরিকল্পনা করা দরকার। সেই চেষ্টা চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *