ষড়ঋতু চক্রে ফাল্গুন-চৈত্রের মিলনে আসে ঋতুরাজ বসন্তকাল। প্রকৃতির রঙিন সাজ জানান দেয় ‘বসন্ত এসে গেছে’।
শীতের নির্জীব প্রকৃতি জেগে ওঠে চাঞ্চল্যে। ঝিরঝির দখিনা বাতাসে দোলে বৃক্ষরাজির পাতা-গুল্মলতা। কবির কাছে যেমন ঋতুরাজ বসন্ত, তেমনি প্রেমিক-প্রেমিকার কাছে এ ভালোবাসার ঋতু।
ফাগুনের প্রথম দিন ভালোবাসা দিবস। তাই তো এই দিনে ভিড় জমেছে সুনামগঞ্জের মেঘালয়ের পাহাড়ঘেঁষা যাদুকাটা ও মাহারাম নদীর তীরে আগুনরাঙা শিমুল বাগানে। তিন সহস্রাধিক শিমুল গাছের ডালে ডালে এবারও ফুটেছে ফুল। বাগানজুড়ে পাখিদের কিচিরমিচিরে মুখর হয়ে উঠেছে আশপাশ। ফুলের ঘ্রাণ না থাকলেও রক্তরাঙা সাজ জুড়িয়ে দেয় হৃদয়।
এই শিমুল বাগান দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন রক্তরাঙা লাল ফুল বিছিয়ে ডাকছে প্রকৃতিপ্রেমী, পর্যটক ও সৌন্দর্যপিপাসুদের। সেই সৌন্দর্য উপভোগ করতে দূর দূরান্ত থেকে এই বাগানে আসেন পর্যটকরা।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার উত্তর বড়দল ইউনিয়নের মানিগাও গ্রামে দেশের বৃহত্তর এই শিমুল বাগানের অবস্থান। মানিগাঁওয়ে বালুকাময় ৯৮ বিঘা (অর্ধেক সরকারি ভূমি) অনাবাদি পতিত জমিতে ২০০২ সালে বাদাঘাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত জয়নাল আবেদীন শখের বশে সারিবদ্ধভাবে তিন হাজারের অধিক শিমুল চারা রোপণ করেন। সময়ের ব্যবধানে এই বাগানটিই এখন আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটে পরিণত হয়েছে। তার নামেই এর নামকরণ করা হয়েছে জয়নাল আবেদীন শিমুল বাগান।
এই বাগানের সৌন্দর্য উপভোগে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যটক, সৌন্দর্যপিপাসু ও প্রকৃতিপ্রেমীদের আগমন ঘিরে স্থানীয় বাসিন্দাদের উপার্জনের পথ সৃষ্টি হয়েছে। বাগানের ভেতর অনেক যুবক আগতদের ছবি তুলে, কেউ ঘোড়ায় চড়িয়ে, কেউবা ফুচকা-চটপটি বিক্রি করে আয় করছেন। এমনকি শিশুরা ফুলের মালা বিক্রি করে, কেউ কেউ বাগানে ভালোবাসার চিত্র এঁকে রেখে সেখানে দাঁড়িয়ে পর্যটকদের ছবি তোলার সুযোগ দিয়ে করছেন উপার্জন।
বাগানের পাশের মানিগাঁওয়ের বাসিন্দা শামিম আহমেদ বলেন, সারা বছরই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার প্রকৃতিপ্রেমী ও পর্যটকের আগমন ঘটে এই বাগানে। তবে রক্তরাঙা ফুটন্ত শিমুল ফুল দেখতে এই সময়েই বেশি পর্যটকের আগমন ঘটে। কিন্তু সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় আগতরা চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। এছাড়া আবাসন ও স্যানিটেশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায়ও ভুগতে হচ্ছে আগতদের।
বাগানে বেড়াতে আসা পর্যটক শরীফ আহমেদ সোলেহ বলেন, বাগানে সারি সারি গাছে লাল টুকটুকে শিমুল ফুল ফুটেছে। ফুলের সৌন্দর্য আর বিভিন্ন প্রজাতির পাখির ডাক বাগানের পরিবেশটা অন্যরকম করে রাখছে। আর এই সৌন্দর্য দেখতে পর্যটকদের আগমনও বাড়ছে।
ঢাকা থেকে আসা পর্যটক লতিফ সরকার বলেন, বাগানটিকে বাইরে থেকে এক রকম আর ভেতরে আরেক রকম, এক কথায় সৌন্দর্যে অসাধারণ। কিন্তু আমাদের মত আগত পর্যটকদের জন্য কোনো ধরনের সুবিধা নেই বাগানে। বাগানে স্যানিটেশনের ভালো মানের ব্যবস্থা তো নেই, পর্যাপ্ত স্যানিটেশন না থাকায় নারীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। সড়কপথের অবস্থা বেশি খারাপ।
আরেক পর্যটক শাকিল আহমেদ বলেন, বাগানের সৌন্দর্যে মনে ভরে গেলেও এখানে পর্যটকদের জন্য সুবিধা নেই। এটার আধুনিকায়ন করা খুবই প্রয়োজন। তাহলে আগতরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন, এখানে আসার আগ্রহ আরও বাড়বে।
বাগানমালিকের ছেলে সাবেক চেয়ারম্যান রাখাব উদ্দিন বলেন, বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও আগত পর্যটকদের জন্য সর্বোচ্চ সুবিধা দিতে চেষ্টা করেছি। বাগানে ফুল ফুটুক আর না ফুটুক, প্রকৃতিপ্রেমীরা ছুটির দিনসহ বিশেষ দিনগুলোতে বেড়াতে আসেন। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারিতে শিমুল ফুল ফোটার পর থেকে পর্যটকদের আগমন বেড়ে গেছে। সরকারিভাবে পর্যটকদের স্বার্থে চলাচলের সড়কটি গুরুত্বসহকারে দ্রুত মেরামত করলে আগতরা সাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন।
যেভাবে যাবেন শিমুল বাগান
রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে করে প্রথমে যেতে হবে সুনামগঞ্জ জেলা শহরে। এরপর সুনামগঞ্জ আব্দুল জহুর সেতু থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা মোটরসাইকেলে জনপ্রতি ১০০ টাকা ভাড়ায় যেতে হবে লাউড়েরগড় বাজার। বাজার পার হয়ে যাদুকাটা নদী আর নদী পার হলেই শিমুল বাগান।
অন্যপথে সুনামগঞ্জ আব্দুল জহুর সেতু পার হয়ে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি নিয়ে ও মোটরসাইকেলে তাহিরপুর উপজেলা গিয়ে, এরপর বাদাঘাট ইউনিয়নের বাদাঘাট বাজার হয়ে শিমুল বাগানে যাওয়া যায়।