জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চুক্তি

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক বৈশ্বিক সম্মেলন কপ-২৮ এ একটি নতুন চুক্তির বিষয়ে সবাই ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। ঐতিহাসিক এই চুক্তিতে প্রথমবারের মতো তেল, গ্যাস ও কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার জন্য দেশগুলোর প্রতি আহবান জানানো হয়েছে।

কয়েক দিনের আলোচনার পর সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশগুলো শেষ পর্যন্ত নতুন সমঝোতায় পৌঁছেছে। যাতে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসতে সব দেশকে ভূমিকা রাখার কথা বলা হয়েছে। তবে অনেক দেশের দাবি অনুযায়ী, একবারেই বাতিল না করে ধীরে ধীরে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে নতুন চুক্তিতে।

সম্মেলনে অবশ্য এটি সবাই মেনে নিয়েছে যে, ভবিষ্যতে গ্যাসের নিঃসরণ আরও বাড়বে। যদিও উন্নত কিংবা অনুন্নত দেশ ভেদে এর মধ্যে পার্থক্য থাকবে। কপ-২৮ এর প্রেসিডেন্ট বলেছেন, দেশগুলো বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই করেছে এবং বিশ্বকে একটি সঠিক পথের নির্দেশনা দিয়েছে।

জলবায়ু সম্মেলনে রাশিয়ার প্রতিনিধি চুক্তিকে উচ্চাভিলাষী আখ্যায়িত করলেও এর প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, কার্বন নিঃসরণ কমাতে প্রতিটি পক্ষই তাদের পছন্দনীয় বাস্তবসম্মত উপায় বেছে নিতে পারে। যুক্তরাজ্যের জলবায়ুমন্ত্রী গ্রাহাম স্টুয়ার্ট বলেছেন, জীবাশ্ম জ্বালানি যুগের অবসান শুরু হলো। আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ।

অস্ট্রেলিয়ার জলবায়ুমন্ত্রী ক্রিস বোয়েন চুক্তিকে ‘শক্তিশালী ফল’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, দুবাইয়ের আলোচনা হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এর আগে চুক্তির বিষয়বস্তু নিয়ে অংশ নেয়া দেশগুলো একমত না হওয়ায় আলোচনা বাড়তি সময়ে গড়িয়েছিল।

আরো পড়ুন  হামাসের টানেলে সমুদ্রের পানি ঢোকানো শুরু করেছে ইসরায়েল

তবে বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, এই সম্মেলন থেকে বাংলাদেশের খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কোনও কারণ নেই। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বিশ্বের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক মন্দার এক পটভূমির মধ্যেই এই জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে এর প্রতি দৃষ্টি কম ছিল। একই সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রুখতে তৈরি করা তহবিলগুলোতে দিন দিন অর্থসংস্থান কমে যাওয়ার কারণে এর থেকে খুব বেশি প্রত্যাশাও ছিল না।

উপকূলভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, আমরা যদি আশা করি, খুব বেশি লাভ হবে না। আমাদেরকে নিজেদের পয়সা দিয়েই ডেল্টা প্ল্যান বলেন, নিজেদের সুরক্ষা বলেন, আমাদেরকেই করতে হবে। তার সাথে তো ইকোনমিক ক্রাইসিস আছেই। তাই আমরা কিন্তু সামনের দিনগুলোতে ভয়াবহ একটা জটিল পরিস্থিতিতে পড়তে যাচ্ছি।

অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর বলেন, কপ-২৮ লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ডে বিভিন্ন দেশের অংশগ্রহণের সুখবর দিয়ে শুরু হলেও, টানা দুই সপ্তাহ ধরে নানা আলোচনার পরে আশানুরূপ ফল দেয়নি। দুবাইয়ে বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধিরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছেন। তবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিয়ে নানা বিতর্কের পর সব দেশের মতৈক্যের ভিত্তিতে চুক্তিতে সম্মত হওয়াটা কঠিন ছিল।

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর বিষয়টি খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত না থাকার কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলো খসড়ার সমালোচনা করেছে। সবার আশা ছিল যে, কয়লা, তেল ও গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের বিষয়ে সম্মতির শুরু হয়তো এখান থেকেই হবে। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে চুক্তির ভাষাতে এগুলো স্থান পায়নি।

আরো পড়ুন  যেভাবে বিশ্বের গাড়ি চুরির কেন্দ্র হয়ে উঠল কানাডা

সোমবার প্রকাশিত খসড়া চুক্তিটিতে জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত না থাকার কারণে এই চুক্তিটিকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছে অনেক দেশ। মঙ্গলবার খসড়া চুক্তিটির নতুন একটি সংস্করণ প্রকাশ করার কথা রয়েছে। এরইমধ্যে এই সম্মেলন বাড়তি সময়ে গড়িয়েছে। সোমবার যে খসড়াটি প্রকাশ করা হয় যেখানে “পর্যায়ক্রমে বন্ধ” করার বিষয়টি বাদ দেয়া হয় এবং এর পরিবর্তে বলা হয়, দেশগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ন্যায্য, সুশৃঙ্খল এবং সমানভাবে কমিয়ে আনতে বলা হয়।

ভাষাগতভাবে এই পরিবর্তন খুব ছোট হলেও জাতিসংঘের নথিতে অল্প একটু পরিবর্তনও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশগুলো কী করতে পারবে আর কী করতে পারবে না তা এটির উপরই নির্ভর করে।

যেসব দেশ এরইমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হচ্ছে, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে যাদের বাড়ি-ঘর তলিয়ে গেছে, ঝড়ের কারণে ঝুঁকির মুখে পড়ছে মানুষের জীবন, সেসব দেশগুলো এই খসড়ার নিন্দা জানিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি খসড়া চুক্তিটিকে অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছে।

এই পুরো সম্মেলনেই আলোচনা হয়েছে যে, তেল, কয়লা এবং গ্যাস পোড়ানোর কারণে নিঃসরিত গ্রিনহাউজ গ্যাস কিভাবে কমিয়ে আনা যায়। কারণ জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে, ঝুঁকির মুখে পড়ছে লাখ লাখ মানুষের জীবন। কিন্তু কোন সরকারই এখনো পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি যে কখন এর ব্যবহার বন্ধ করা হবে।

দুবাইতে থাকা কপ-২৮ এর জলবায়ু বিষয়ক সম্পাদক জাস্টিন রুউলেট বলেন, এমন একটি চুক্তি হতে হবে যেটি একই সাথে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার বিষয়টিও থাকবে এবং যা তেল সমৃদ্ধ দেশগুলোর কাছেও গ্রহণযোগ্য হবে। বিবিসি বাংলা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *